রবিবার, ১৪ পৌষ, ১৪৩১ | ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন সিলেট অঞ্চলের ১২টি চা বাগানে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বকেয়া মজুরির দাবিতে শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করছেন।

জানা গেছে, ২০২২ সালের শ্রমিক বিক্ষোভের পর থেকে চা শিল্পে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি বাগান মালিকরা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাগান পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঋণসংক্রান্ত জটিলতায় কৃষি ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড় না হওয়ায় এনটিসির বাগানগুলোয় কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অন্তত ৪২টি চা বাগান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বাগান মালিকদের দাবি, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাগান পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অকশনে (নিলাম) সিন্ডিকেটের আধিপত্য ভেঙে দিতে হবে, পাশাপাশি ব্যাংক খাত থেকে ঋণপ্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে।

উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান সিলেটের মালনীছড়ায় ১৮৫৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, পঞ্চগড়সহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায়। বিশেষ করে সিলেটের তিন জেলার ১৩৫টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯২, হবিগঞ্জে ২৪ ও সিলেটে রয়েছে ১৯টি। এসব বাগানে অর্ধলক্ষাধিক চা শ্রমিক কাজ করেন।

এদিকে সারা দেশে ন্যাশনাল টি কোম্পানির ফাঁড়ি বাগানসহ ১৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ১৭ হাজার চা শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু গত ছয় সপ্তাহ ধরে এসব বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিক ও তাদের স্বজনরা। বন্ধ হওয়া বাগানগুলোর মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজারের বিজয়া; কুলাউড়ার প্রেমনগর; কমলগঞ্জের খুরমা, চাম্পা রায়, পাত্রখলা, মদনমোহনপুর ও মাধবপুর চা বাগান। এছাড়া হবিগঞ্জের চণ্ডীছড়া, তেলিয়াপাড়া, জগদীশপুর ও পারকুল চা বাগান। অন্যদিকে সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিকরাও মজুরি পাচ্ছেন না। এছাড়া বাঘাছড়া, কুরঞ্জি ও পদ্মছড়া নামের তিনটি ফাঁড়ি বাগানের শ্রমিকরাও মজুরি থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি জানান, ন্যাশনাল টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন চা শ্রমিকরা গত এক সপ্তাহ থেকে কাজে যাচ্ছেন না। কারণ তারা বেশ কয়েক সপ্তাহ থেকে মজুরি পাচ্ছেন না। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছেন। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি করছি না, প্রাপ্যটুকু চাচ্ছি। বাগানের বাইরে কাজ করার মতো জায়গা নেই। চাইলেও সবাই যেতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’

অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকট চলমান থাকায় মালিক পক্ষ চা বাগান পরিচালনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে। তাদের দাবি, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে চা বিক্রি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ঋণের সুদহার ও বৈরী আবহাওয়ায় সংকট দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া ভারত থেকে চোরাইপথে আসছে নিম্নমানের চা, যা দেশীয় বাজারে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বাগান মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্রোকারদের সিন্ডিকেট, প্রতিকূল আবহাওয়া ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মানও।

সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চা শিল্পের জন্য সম্প্রতি ১০টি সুপারিশ সংবলিত আবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পাঠিয়েছেন সিলেটের বাগান মালিকরা। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ প্রায় ২৫০ টাকা। বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশীয় চা সংসদ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ে চায়ের নিলামমূল্য নিম্নতম ৩০০ টাকা নির্ধারণ করলে চা শিল্প আপাতত রক্ষা পেতে পারে।

সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, ছোট-বড় প্রায় সব চা বাগানই বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে হাইপোথেটিক লোন নিয়ে থাকে। চায়ের নিলাম মূল্য সরাসরি কৃষি ব্যাংকে জমা হয়ে তা পরিশোধ করা হয়। এ ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বর্তমানে ১৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ অবস্থায় তা পরিশোধ করা বাগানগুলোর পক্ষে অসম্ভব। তাই বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পরিশোধের সুদের হার ৯ শতাংশ রাখা, সময়সীমার ব্যাপারে শিথিল নীতি গ্রহণ এবং রুগ্‌ণ ও উন্নয়নশীল চা বাগানকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে চা বোর্ডের বাধ্যতামূলক ২ দশমিক ৫ শতাংশ সম্প্রসারণ আবাদ কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখে শূন্যস্থান পূরণের ওপর জোর দেয়া জরুরি বলে সুপারিশে উল্লেখ করেন মালিকরা।

এছাড়া বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় চা শিল্পকে ভ্যাট ও ট্যাক্স থেকে সাময়িক অব্যাহতি প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চা আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন মালিকরা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা জানান, ‘চা উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। মালিকপক্ষ সরকারি ঋণ পাচ্ছে না বলে নানা অজুহাত দেখাচ্ছে। এতে সিলেট ভ্যালির ২৩টি বাগানের মধ্যে আটটির শ্রমিকদের মজুরি ও রেশন অনিয়মিত হয়ে পড়ছে।’

এনটিসির মহাব্যবস্থাপক এমদাদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে প্রতি বছরের আগস্টে ঋণ অনুমোদন হয়। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে সেটা পেতে সমস্যা হচ্ছে। তাদের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন না হওয়ার কারণে এ বিলম্ব।’ তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চা শিল্পের এ সংকট দূরীকরণের চেষ্টা চলছে বলেও জানান এনটিসির মহাব্যবস্থাপক।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version