ব্যাংক সুদহার বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়িরা। তারা বেশি সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে, নাকি পারবেন না, এই নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুধু বড় ব্যবসায়িই নয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও প্রায় একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। উচ্চ সুদহারের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট ব্যবসা-বাণিজ্যে শুধু বাধা তৈরি করছে তা নয়, সমস্যার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় এর সরাসরি আঘাত পড়ছে কর্মসংস্থান তৈরিতে। ‘সংকট’ বাড়ছে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে। এর ধাক্কা লাগছে কর্মহীন হয়ে পড়া বা উচ্চমূল্যের বাজারে খাপ খাওয়াতে না পারা কম বা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর।
দেশের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে গত দুই বছর ধরে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দশা শুরু হয় মূলত মহামারীর সময় বিশ্ব অর্থনীতি পুরো স্থবির হয়ে পড়লে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে তেলের বাজার এবং ডলারের বিনিময় হার অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে অর্থনীতির বিপদ আরো বাড়ে।
সব মিলিয়েই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে তখন টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমা অর্থনীতি ধীর হয়ে পড়ায় পোশাকের বাজারে রপ্তানি আদেশ কমছিল। আর আমদানি খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছিল দেশের মানুষ।
ওই পরিস্থিতিতেও ডলারের বিনিময় হার প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয়নি। অর্থনীতির বিশ্লেষকদের তরফে নীতি সুদহার বাড়ানো এবং ব্যাংকের সুদের হার বাজারের ওপর ছাড়ার পরামর্শের পরও নয়-ছয় সুদহার পদ্ধতি বহাল রাখা হয়। পরে ২০২৩ সালে আইএমএফের চাপে নয়-ছয় ব্যবস্থা তুলে নিয়ে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
এরসঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো সুদহার বাড়ানো শুরু হলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সুদের হার। চাপে পড়তে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। পণ্য আমদানিও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুই মাসে দুইবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। একবছর আগে ঋণের সুদ হার যেখানে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে ছিল, এখন তা পৌঁছে গেছে ১৪ শতাংশে। অথচ মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্য নিয়ে রেপো হার বাড়ানো হচ্ছে, সেই মূল্যস্ফীতি এখনও রয়ে গেছে দুই অঙ্কের কাছাকাছি, ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে।
দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম সূচক হচ্ছে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার তথ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। গত জুলাই ও অগাস্টে ১০ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। ওই বছরের জুলাই-অগাস্টে এলসি খোলা হয়েছিল ১১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের।
আবার ওই দুই মাসে ১০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানির এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ কম নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ; আগের অর্থবছরের একইসময়ে যা ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে জুনে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এদিকে অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর, যিনি আগে থেকেই সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলে আসছিলেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর সে পথেই হেঁটেছেন তিনি। প্রথমে ২৫ অগাস্ট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপো হার করেন ৯ শতাংশ। পরের মাসে এটি আবার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করেন। আগের সরকার চলতি বছরের জানুয়ারিতে একবার ২৫ বেসিস পয়েন্ট এবং মে মাসে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ায় রোপো হার। স্বল্প সময়ের মধ্যে চার দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ব্যাংকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার বেড়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছায়।
ব্যাংক ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে পৌঁছে যাওয়ায় ব্যবসার খরচ বাড়বে ও মুনাফায় প্রভাব ফেলবে বলে গত শনিবার এক সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘এমন দেশ নেই যেখানে ব্যবসায়ীরা দুই অঙ্কের ব্যাংক সুদহারে মুনাফা করতে পারেন। দেশে এখন সুদের হার ১৪ শতাংশ।’
তার ভাষ্য, এর ফলে এই মুহূর্তে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। অথচ বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের সঙ্গে পণ্যের মান, ভাবমূর্তি ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ সুদহারের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘প্রকৃত সুদের হার ১৪ শতাংশেরও বেশি।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার পর সুদের হার প্রথম বাড়ে। মীর নাসিরের মতে, আইএমএফের ঋণ প্রকারান্তরে দেশের ওপর ‘ক্ষতিকর প্রভাব’ ফেলে। সেটা ব্যবসায়ীদের উপকারে আসে না।