গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদের হাতিয়ারে পরিণত হওয়া বর্তমান সংবিধানের বদলে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংস্কার করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পরিষদ।
রাজধানীর একটি হোটেলে আজ ‘জাতীয় নাগরিক পরিষদ’ আয়োজিত ‘সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ আহবান জানান।
এসময়, সংগঠনের পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার ফিরদাউসুর রহমান।
বৈঠকে সংবিধান সংস্কারের বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তব্য দেন – সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী, সাবেক সচিব এস. এম. জহরুল ইসলাম, মুফতি হারুন ইযহার, বিশিষ্ট কবি অধ্যাপক আব্দুল হাই শিকদার, লেখক ও কবি রেজাউল করিম রনি, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসাইন, অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানসহ অন্যান্য বিশিষ্ট আলেম-মুফতিগণ।
আলোচনায় ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার রূপরেখা তুলে ধরা হয়, যেখানে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, জাতীয় ঐক্য এবং সামাজিক সংহতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জনকল্যাণমূলক সংস্কারের লক্ষ্য সামনে রেখে, জবাবদিহিতাপূর্ণ সংসদ ও প্রশাসন, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা, এবং একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সুষ্পষ্ট বণ্টন, মেয়াদ, ভারসাম্য, দায়িত্ব ও ভূমিকা নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট সুপারিশও তুলে ধরা হয়।
প্রস্তাবনায় সংবিধানে নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে নাগরিকদের বিচার বহির্ভূত হয়রানি ও গুম থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত , প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ও গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত , বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় বিচারকদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি পৃথক বিচারবিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন বাজেট গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বর্তমান সংবিধানের মুখবন্ধে ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মূল প্রেরণা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং ইসলামকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ জানানো হয়।
আলোচনায় ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়া, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় রেখে, প্রস্তাবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার পাশাপাশি সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। একই সাথে, ধর্মবিরোধী, উস্কানিমূলক ও ধর্ম নিয়ে কটূক্তির বিরুদ্ধে আইনি নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সংবিধানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার প্রস্তাব করে তাদের পরিচয়ের জন্য ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা অন্য কোনো বিদেশি পরিভাষা ব্যবহার না করে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়কে স্বীকৃতি দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়।
এছাড়াও, প্রবাসী শ্রমিকদের বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সকল ধারাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পরিবেশ সুরক্ষাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করাও এই সংস্কার প্রস্তাবের অংশ হিসেবে বৈঠকে তুলে ধরা হয়।
পাশাপাশি, তরুণদের বিপুল আত্নত্যাগের মহিমা সমুন্নত রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতার আমন্ত্রণ জানায় জাতীয় নাগরিক পরিষদ।
বৈঠক শেষে, দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে একটি সংক্ষিপ্ত মোনাজাত পরিচালনা করেন পরিষদের সদস্যরা।