বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় চাপ বাড়ছেই। এমনিতেই লোহিত সাগরপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে অনেক জাহাজ এই পথ এড়িয়ে চলত। এখন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ইসরায়েল-ইরান-লেবানন সংঘাত শুরু হওয়ায় আরও অনেক জাহাজ এই পথ এড়িয়ে চলছে। ফলে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়ছে।
সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহব্যবস্থা চাপের মুখে আছে। যেমন মধ্য আমেরিকার খরা ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় বন্দরগুলোতে ধর্মঘট—এসব কারণেও বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোয় শ্রমিকদের ধর্মঘট সম্প্রতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী সরবরাহ সংকোচনসহ মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ান
কোভিড-১৯ মহামারির পর বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন কেবল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জেরে তেলের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি আকাশে ওঠে। তা যখন কমতে শুরু করে, তখন নতুন সংকট হয়ে দাঁড়ায় গত বছরের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া হামাস-ইসরায়েল সংঘাত। সেই সংঘাতের জেরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরপথে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে। সেই হামলা এখনো অব্যাহত আছে।
হুতিদের হামলা এড়াতে পণ্যবাহী জাহাজগুলো সুয়েজ খাল এড়িয়ে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এতে পরিবহন ব্যয় একলাফে অনেকটা বেড়েছে। সেই আক্রমণের আগে বিশ্বব্যাপী মোট পণ্য পরিবহনের ১২ শতাংশ লোহিত সাগরপথে হতো। নিরাপত্তা শঙ্কায় বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাহাজ বা পণ্য পরিবহন প্রতিষ্ঠান মেয়ার্সকসহ অনেক কোম্পানি এই পথ এড়িয়ে চলছে। উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাতায়াতে অতিরিক্ত ১০ দিন লাগে। এর ফলে সময় ও ব্যয় উভয়ই বেশি লাগছে।
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে চলাচলকারী মালবাহী কোম্পানিগুলোকে জ্বালানির জন্য ৪০ শতাংশ বাড়তি ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। কনটেইনারের ভাড়াও বেড়েছে। সম্প্রতি নতুন করে শুরু হওয়া লেবানন, ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাতে আরও অনেক কোম্পানি লোহিত সাগর এড়িয়ে চলাচল করছে।
সাম্প্রতিক সংঘাতে নতুন করে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন জাহাজ পরিবহন বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান জেনেটার প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড। ইতিমধ্যে অধিকাংশ জাহাজ এই পথ এড়িয়ে চলছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সংঘাত আরও বাড়লে কোনো জাহাজই লোহিত সাগরপথে চলতে চাইবে না। সেই সঙ্গে যেসব জাহাজ আগে থেকে এই পথ এড়িয়ে চলছে, তাদের এই পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না–ও হতে পারে।
জেনেটার তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে পূর্ব এশিয়া ও উত্তর ইউরোপের মধ্যে চলাচলকারী ৪০ ফুট কনটেইনারের ভাড়া ছিল ৮ হাজার ৫৮৭ ডলার, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় যা ৪৬৮ শতাংশ বেশি। হুতি বিদ্রোহীদের হামলার জেরে ভাড়া এতটা বেড়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরের ধর্মঘটের কারণে এরই মধ্যে উত্তর ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলেও কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। গত মঙ্গলবার ৪০ ফুট কনটেইনারের গড় ভাড়া ছিল ২ হাজার ৮৬১ ডলার, আগস্টের শেষের দিকে যা ছিল ১ হাজার ৮৩৬ ডলার। মূলত পণ্য সরবরাহের সময় বেড়ে যাওয়ায় কনটেইনারের ভাড়া বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় বন্দরের শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লংশোরম্যান অ্যাসোসিয়েশনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য এই ধর্মঘট করেন; যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের ১৪টি বন্দরে এর প্রভাব পড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ, এমনকি বাল্টিমোর ব্রিজ ধসের মতো ঘটনার কারণেও সরবরাহব্যবস্থায় চাপ বেড়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে পণ্য উৎপাদক ও খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছিলেন, লোহিত সাগর এড়িয়ে আফ্রিকা ঘুরে চলাচল করতে চার সপ্তাহ বাড়তি সময় লাগছে। এর ফলে ভলভো ও টেসলার মতো গাড়ি কোম্পানিগুলোর হাতে সময়মতো যন্ত্রাংশ পৌঁছাচ্ছে না। তাদের উৎপাদন স্থগিত করতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা ডিএফএস ও জেডি স্পোর্টস বলছে, লোহিত সাগর সংকটে তাদের বেচাকেনায় প্রভাব পড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চলমান সংকটের প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর পড়বে। সরবরাহব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার কারণে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া কিছু পণ্যের সংকট হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের আরেকটি অনিবার্য ফল হলো, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। আজ শনিবার সকালে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭৮ ডলারে উঠেছে, গত সপ্তাহের শুরুতে যা ছিল ৭১ ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, তেলের দাম ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে দেশটির জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের পূর্বাভাস, ইরান দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উৎপাদন করতে পারে। লোহিত সাগরপথে সমস্যা হলে সরবরাহে আরও বিঘ্ন হবে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানিতে তার প্রভাব পড়বে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এর আগে ২০২২ সালে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশের ঘরে চলে গিয়েছিল। তার ধাক্কায় সারা পৃথিবীতেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তখন খাদ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালি, জ্বালানি—সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। এর মধ্যে আবার ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়েছে। ফলে তেলের দাম ৯০ ডলারে উঠে গেলে আবারও সারা পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তবে বাজারে তেলের সরবরাহ এখন ভালো। ওপেক উৎপাদন হ্রাসের নীতি থেকে সরে আসছে। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চাহিদার সংকট থাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।